বর্ষিয়ান জননেতা ভাষা সৈনিক জামায়াতে ইসলামীর সাবেক আমীর অধ্যাপক গোলাম আযমের জামিন আবেদন নাকচ করে দিয়ে কারাগারে পাঠিয়েছে আন্তর্জাতিক অপরাধ ট্রাইব্যুনাল। ৮৯ বছর বয়স্ক এই মজলুম নেতার বার্ধক্যজনিত শারীরিক অবস্থার কথা বিবেচনা না করেই ট্রাইব্যুনালের চেয়ারম্যান বিচারপতি নিজামুল হক সদস্য বিচারপতি এটিএম ফজলে কবির ও একেএম জহির আহমেদের নেতৃত্বাধীন ট্রাইব্যুনাল এই আদেশ দেন। গতকাল দুপুরে ঢাকা কেন্দ্রীয় কারাগারে নেয়ার পর বিকেল ৪টার দিকে ঢাকার পিজি হাসপাতালের প্রিজন সেলে ভর্তি করা হয়। গতকাল সন্ধ্যায় এ রিপোর্ট লেখা পর্যন্ত তাকে সেখানেই রাখা হয়েছে। ট্রাইব্যুনাল তার আদেশে অধ্যাপক গোলাম আযমের স্বাস্থ্যগত বিষয়টি গুরুত্বের সাথে দেখারও নির্দেশ দিয়েছেন।
বার্ধক্যজনিত অসুস্থতার কারণে ইতোপূর্বে সাবেক মন্ত্রী আবদুল আলিমকে শর্ত সাপেক্ষে জামিন দিলেও অধ্যাপক গোলাম আযমের ক্ষেত্রে সেটা বিবেচনা করা হয়নি। অথচ আবদুল আলিমের চেয়েও তার বয়স প্রায় ১০ বছর বেশী এবং তিনি ব্যাক পেইন, হাইপার টেনশন, হৃদরোগ আর্থারাইটসসহ নানা বার্ধক্যজনিত রোগে আক্রান্ত। গত নবেম্বরে তার জন্য গঠিত একটি উচ্চ পর্যায়ের মেডিকেল বোর্ডের নিবিড় তত্ত্বাবধানে চিকিৎসাধীন ছিলেন। গতকাল আদালত কক্ষে তাকে উঠানো হয় হুইল চেয়ারে করে এবং একইভাবে নামানো হয়। আগামী ১৫ ফেব্রুয়ারী তার বিরুদ্ধে আনিত অভিযোগের ওপর শুনানী অনুষ্ঠিত হবে।
পুলিশ, র্যাবসহ বিপুল সংখ্যক নিরাপত্তা রক্ষীর কঠোর নিরাপত্তা বেষ্টনেরমধ্যে গতকাল সকাল ৯টা ৪০ মিনিটে অধ্যাপক গোলাম আযম তার আইনজীবী ব্যারিস্টার আবদুর রাজ্জাকের গাড়ীতে চড়ে হাজির হন পুরাতন হাইকোর্টস্থ আন্তর্জাতিক অপরাধ ট্রাইব্যুনালে। বিভিন্ন সংবাদ পত্র, টেলিভিশন চ্যানেল, সংবাদ সংস্থা ও সংবাদ মাধ্যমের বিপুল সংখ্যক সাংবাদিকদের ভীড়ে গাড়ী থেকে নেমে হুইল চেয়ারে বসাএবং তাকে দোতলায় আদালত কক্ষে উঠানোর সময় পুলিশের সাথে মিডিয়া কর্মীদের ধাক্কাধাক্কি হয়। সরকার এবং ডিফেন্স উভয় পক্ষের আইনজীবী, সাংবাদিক ও অবজার্ভারদের উপস্থিতিতে গতকাল আদালত কক্ষে যেন তিল ধারণের ঠাই ছিল না। আদালতের বাইরে হাইকোর্টের সামনে মুক্তিযোদ্দা কমান্ডের ব্যানারে গোলামআযমের গ্রেফতারের দাবিতে মানব বন্ধন ও মাইক লাগিয়ে বক্তৃতাও চলছিল। সেখানে শাহরিয়ার কবির, মুনমাকির মামুনরা উপস্থিত থাকলেও পরে তাদেরকেক ট্রাইব্যুনাল থেকে বের হতে দেখা যায়।
সকাল ১০টা ৩২ মিনিটে বিচারপতি নিজামুল হক নাসিম, বিচারপতি এটিএম ফজলে কবির ও একেএম জহির আহমেদের সমন্বয়ে গঠিত আন্তর্জাতিক অপরাধ ট্রাইব্যুনাল আদালত কক্ষে উপস্থিত হলে কাঠগড়ায় সমাসীন অধ্যাপক গোলাম আযম সবাইকে বলেন, আসসালামু আলাইকুম। ৩ বিচারক এজলাসে বসলেই ব্যারিস্টার আবদুর রাজ্জাক বলেন, এই আদালতের গত ৯ জানুয়ারীর নির্দেশনা মোতাবেক অধ্যাপক গোলাম আযমকে হাজির করা হয়েছে। তিনি কাঠগড়ায় উপস্থিত আছেন। অধ্যাপক গোলাম আযমও দাড়িয়ে হাত উচু করেন ট্রাইব্যুনালের কার্যক্রম শুরু হলে প্রথমেই তার জামিন আবেদনের শুনানী করেন ব্যারিস্টার আব্দুর রাজ্জাক। গত ৯ জানুয়ারী অধ্যাপক গোলাম আযমের বিরুদ্ধে চীফ প্রসিকিউটর আনিত
অভিযোগ আমলে নিয়ে আদেশ দেয় ট্রাইব্যুনাল। তবে ঐ দিন তার গ্রেফতারি পরোয়ানা জারি না করে তার আইনজীবী ব্যারিস্টার আব্দুর রাজ্জাকের প্রতি নির্দেশনা দিয়ে বলা হয়, আপনি তাকে ১১ তারিখে হাজির করবেন। আপনি হাজির করতে না পারলে আমরা গ্রেফতারি পরোয়ানার বিষয়ে বিবেচনা করবো। ঐ নির্দেশনা মোতাবেক গতকাল ব্যারিস্টার রাজ্জাক বয়োবৃদ্ধ এই মজলুম জননেতাকে হাজির করেন ট্রাইব্যুনালে। হুইল চেয়ারে ধরে ওপরে উঠানো এবং নামানোর কাজ করেন তার দুই ছেলে এবং অন্য কয়েকজন।
জামিন আবেদনের শুনানিতে ব্যারিস্টার আব্দুর রাজ্জাক বলেন, অধ্যাপক গোলাম আযমের বর্তমান বয়স ৮৯ বছর পেরিয়ে গেছে। তিনি ভাষা সৈনিক এবং ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয় কেন্দ্রীয় ছাত্র সংসদের (ডাকসু) জিএস ছিলেন দুই দুই বার। তিনি বাংলাদেশ জামায়াতে ইসলামীর আমীর হিসেবে দীর্ঘদিন দায়িত্ব পালন করেছেন। বয়সের কারণেই তিনি এখন একা চলতে পারেন না। হুইল চেয়ার প্রয়োজন হয়। হৃদরোগ, ব্যাক পেইন, আর্থারাইটিসসহ নানা জটিল রোগে তিনি ভুগছেন। গত নবেম্বরে তার চিকিৎসার জন্য একটি মেডিকেল বোর্ড গঠন করা হয়। ঐ বোর্ডের অধীনে তিনি এখন চিকিৎসাধীন আছেন। বাসায় নিবিড় পরিচর্যার মাধ্যমে এখন তিনি কোন মতে দিন যাপন করছেন।
আন্তর্জাতিক অপরাধ আইনে ১৯৭৩ ও বিধি উল্লেখ করে তিনি বলেন, এই ট্রাইব্যুনাল যেকোন পর্যায়ে যেকোন অভিযুক্ত ব্যক্তিকে জামিন দিতে পারেন। অধ্যাপক গোলাম আযমের বিরুদ্ধে অভিযোগ এই ট্রাইব্যুনাল আমলে নিয়েছে। কিন্তু তার কপি না পাওয়ায় তিনি এখানো জানেন না যে তার বিরুদ্ধে কি অভিযোগ।
ব্যারিস্টার আব্দুর রাজ্জাক ইতঃপূর্বে সাবেক মন্ত্রী আব্দুল আলিমকে শর্ত সাপেক্ষে দেয়া জামিনের উদাহরণ দিয়ে বলেন, কেসটি একই ধরনের। বয়সে অধ্যাপক গোলাম আযম আব্দুল আলিমের চেয়ে আরো ১০ বছরের বেশি। অসুস্থ দু'জন একই ধরনের।
আদালতে উপস্থিত অধ্যাপক গোলাম আযমের ছেলে সাবেক সেনা কর্মকর্তা ব্রিগেডিয়ার জেনারেল (অব.) আব্দুল্লাহিল আমান আযমীকে দেখিয়ে ব্যারিস্টার রাজ্জাক বলেন, তার জিম্মায় জামিন দেয়া যেতে পারে। তিনি আদালতের নির্দেশনা মতে কোর্টে হাজির হবেন। বাড়ির বাইরে যাবেন না।
জামিন আবেদনের বিরোধিতা করে চীফ প্রসিকিউটর গোলাম আরিফ টিপু বলেন, গোলাম আযমের বয়স হয়েছে সত্য। এই বয়সে কিছু জটিল রোগ ব্যাধিও আসতে পারে। তবে বিচারিক ক্ষেত্রে বয়স কখনো বিবেচ্য নয়। তিনি জামায়াতের প্রধান হিসেবে ১৯৭১ সালে যত মানবতাবিরোধী অপরাধ ঘটেছে তার সবকিছুর মদদদাতা। তিনি সব অপকর্মের মাস্টার মাইন্ড। মিসরে হোসনী মোবারককে জেলখানায় রেখে বিচার করা হচ্ছে। তার বয়স গোলাম আযমের চেয়ে বেশি। অনুরূপ জার্মানির একটি ঘটনার বর্ণনা দেন তিনি। টিপু আরো বলেন, তার বিরুদ্ধে একাত্তরের মানবতাবিরোধী সুনির্দিষ্ট বহু অভিযোগ রয়েছে যার ভিত্তিতে এই ট্রাইব্যুনাল অভিযোগ আমলে নিয়েছে। এখন মামলাটি চূড়ান্তভাবে বিচার শুরুর পর্যায়ে রয়েছে। এই পর্যায়ে জামিন দেয়া হলে বিচার কার্য ব্যাহত হবে। তিনি জামিন আবেদন না মঞ্জুর করার নিবেদন করেন।
তার বক্তব্যের জবাবে আবারো সংক্ষিপ্ত শুনানি করেন ব্যারিস্টার রাজ্জাক। তিনি বলেন, হোসনী মোবারক কনডিকটেড, যেটা গোলাম আযম নন। তাছাড়ও তিনি বর্তমানে কোন দলের পদ পদবীতে না থাকায় কোন প্রভাব সৃষ্টিকারী ব্যক্তি বা বিচারিক কাজ ব্যাহত করার মত ব্যক্তি নন। তাছাড়া বিচার শুরু হয়নি। অভিযোগের উপর শুনানির তারিখ রয়েছে সামনে। তার আগ পর্যন্ত এই অভিযোগ ভিত্তিহীন। ট্রাইব্যুনালের ক্ষমতা আছে যে কোনো স্টেইজে জামিন দেয়ার।
উভয় পক্ষের শুনানি শেষে বেলা সোয়া ১১টায় আদেশ দেন ট্রাইব্যুনালের চেয়ারম্যান বিচারপতি নিজামুল হক নাসিম। তার আগে কয়েক মিনিট তিন বিচারক নিজেদের মধ্যে শলাপরামর্শ করেন। আদেশে বলা হয়, তিনি হুইল চেয়ার ছাড়া চলতে পারেন না বিষয়টি এমন নয় যা আব্দুল আলিমের মতো বিবেচনা করা যেতে পারে। তাছাড়াও আব্দুল আলিমের মামলাটি এখনো তদন্ত পর্যায়ে রয়েছে। আর গোলাম আযমের অভিযোগ আমলে নেয়া হয়েছে ইতোপূর্বে। এখন বিচার শুরুর পর্যায়ে রয়েছে। বিচারের ক্ষেত্রে বয়স বিবেচ্য বিষয় নয়। তবে তার প্রয়োজনীয় চিকিৎসা দেয়া এবং আইনজীবীর সাথে সাক্ষাতের ব্যবস্থা করার জন্য ঢাকা কেন্দ্রীয় কারাগারের প্রতি নির্দেশনা দিয়ে জামিন আবেদন খারিজ করে দেন।
জামিন আবেদন নাকচ করার পর ব্যারিস্টার আব্দুর রাজ্জাক কারাগারে অধ্যাপক গোলাম আযমকে ডিভিশন দেয়ার আবেদন জানান। তিনি বলেন, ভাষা আন্দোলনসহ বিভিন্ন সময়ে তিনি কারাগারে গিয়েছেন। উনি সব সময়ই ডিভিশনে ছিলেন। কিন্তু বিচারপতি নাসিম বলেন, এই আদেশ আমরা দিতে পারি না। এটা প্রপার অথরিটির কাছে করতে হবে। জেল অথরিটির কাছে দরখাস্ত করার পরামর্শ দেন।
বেলা পৌনে ১২টার দিকে অধ্যাপক গোলাম আযমকে আদালত কক্ষ থেকে হুইল চেয়ারে করে নামিয়ে নীচের হাজতখানায় রাখা হয়। পরে বিপুল পুলিশ ও র্যাব পরিবেষ্টিত অবস্থায় একটি পিকআপ ভ্যানে করে নিয়ে যাওয়া হয় কেন্দ্রীয় কারাগারে। বেলা ১২টা ১৮ মিনিটে সরাসরি কারাগারের ভিতরে গাড়িটি ঢুকিয়ে দেয়া হয়। বেলা ৪টার দিকে তাকে কারাগার থেকে বের করে ঢাকায় বঙ্গবন্ধু মেডিকেল বিশ্ববিদ্যালয়ের (পিজি হাসপাতাল) প্রিজন সেলে ভর্তি করা হয়। জেলার মাহবুবুল ইসলাম জানিয়েছেন, ‘আইনজীবীদের আবেদনে গোলাম আযমকে কারা হেফাজতে মুজিব মেডিকেলে রাখা হয়েছে।' নাজিম উদ্দীন রোডস্থ কারাগার থেকে বিকেল ৪টায় তাকে ‘একটি অ্যাম্বুলেন্সে করে তাকে হাসপাতালে নিয়ে যাওয়া হয়' বলে জানিয়েছেন জেলার। এর আগে সকালে ট্রাইব্যুনালে জামিন আবেদন খারিজ হয়ে যাবার পর দুপুর ১২.১৮ মিনিটে একটি প্রিজন ভ্যানে করে ট্রাইব্যুনাল থেকে ঢাকা কেন্দ্রীয় কারাগারে নেয়া হয় অধ্যাপক গোলাম আযমকে। চকবাজার থানার ভারপ্রাপ্ত কর্মকর্তা (ওসি) মোহাম্মদ আলী জানিয়েছেন, বুধবার দুপুর সোয়া ১২টার পরে শাহবাগ থানা পুলিশের সঙ্গে যৌথভাবে অধ্যাপক আযমকে ঢাকা কেন্দ্রীয় কারাগারে নিয়ে যায় তার থানা পুলিশ।