সাইেটর সকল তথ্য

Welcome To Blog World ( ইউসুফ)

''Welcome To Blog World"

News

মালকোচা লুঙ্গি পরা সাঈদীকে বোগলে লুটের টিন মাথায় কাসা পিতলের জিনিস নিয়ে যেতে দেখেছি- সাক্ষী নবীন মাওলানা সাঈদীর বিরুদ্ধে ২ জন সাক্ষীর জবানবন্দী সম্পন্ন || 

শহীদুল ইসলাম : আন্তর্জাতিক অপরাধ ট্রাইব্যুনালে সরকার পক্ষের হাজির করা সাক্ষী মুক্তিযোদ্ধা বলে দাবিদার রুহুল আমিন নবীন অভিযোগ করেছেন যে, ১৯৭১ সালের ৭ মে পাড়েরহাট বাজারে মাওলানা দেলাওয়ার হোসাইন সাঈদীকে লুটের মাল নিয়ে যেতে দেখেছেন। তিনি বলেন, ঐ দিন বেলা সাড়ে ১০টা থেকে অনুমান ১১টার দিকে পাড়েরহাট বাজারের মাসুম স্টোরের সামনে আমি দাঁড়িয়ে ছিলাম। তখন তৎকালীন দেলাওয়ার হোসেন সিকদারকে (বর্তমান সাঈদী) বোগলে ঢেউটিন মাথায় ঝাকা নিয়ে যেতে দেখেছি। এই ঝাকার মধ্যে কাসা পিতলের প্লেট, গ্লাস, বাটি, জগ ইত্যাদি ছিল। পাঞ্জাবি ও লুঙ্গি মালকোচা দিয়ে পরা দেলাওয়ার সিকদারকে আমি আমার কাছে থাকা রিভলভার দিয়ে শুট করতে চেয়েছিলাম। নূরুল হক মৌলভী আমাকে বাধা দেয়ার কারণে তখন তাকে গুলী করি নাই। ভানু সাহা নামের এক হিন্দু মহিলাকে কয়েক মাস ধরে ক্যাম্পে রেখে পাক হানাদার বাহিনী ধর্ষণ করেছে বলেও তিনি অভিযোগ করেন। তবে আগের দিন এক নম্বর সাক্ষী মাহবুবুল আলম হাওলাদার
সংশ্লিষ্ট খবর

অভিযুক্ত পক্ষের ৩টি আবেদনের একটিও গৃহীত হয়নি
মাওলানা সাঈদীর বিরুদ্ধে আনীত অভিযোগ সম্পূর্ণ মিথ্যা ও রাজনৈতিক উদ্দেশ্যপ্রণোদিত
মাওলানা সাঈদীর আইনজীবীদের ঘটনাস্থল পরিদর্শনে বাধা দেয়া হয়েছে
সাঈদীর আইনজীবী দলের পিরোজপুর ত্যাগ
মাওলানা সাঈদীর আইনজীবীদের পিরোজপুরে মামলার ঘটনাস্থল পরিদর্শন

এ সংশ্লিষ্ট আরো খবর
ঐ ধর্ষণের সাথে মাওলানা সাঈদীকে জড়িত করে সাক্ষ্য প্রদান করলেও ২নং সাক্ষী শুধুই পাক বাহিনীর জড়িত থাকার কথা উল্লেখ করেন।

বাংলাদেশ জামায়াতে ইসলামীর নায়েবে আমীর মাওলানা দেলাওয়ার হোসাইন সাঈদীর বিরুদ্ধে ২নং সাক্ষী হিসেবে সাক্ষ্য দিতে আসা রুহুল আমিন নবীন গত বুধবার বিকেলে সাক্ষ্য দেয়া শুরু করেন। ১৫ মিনিট তার বক্তব্য লিপিবদ্ধ করার পর ঐ দিন আদালত মূলতবি করা হয়।

গতকাল বৃহস্পতিবার আন্তর্জাতিক অপরাধ ট্রাইব্যুনালের ৩ বিচারক নিজামুল হক নাসিম, এটিএম ফজলে কবির ও একেএম জহির আহমেদ সকাল ১০টা ৪০ মিনিটে এজলাসে বসেন। মাওলানা সাঈদীকে তার মিনিট খানেক আগেই নিয়ে আসা হয় ট্রাইব্যুনালের কাঠগড়ায়। আর বেলা সাড়ে ৯টা থেকে তাকে বসিয়ে রাখা হয়। ট্রাইব্যুনালের নীচ তলার হাজত খানায়। ঢাকা কেন্দ্রীয় কারাগার থেকে তাকে নিয়ে আসা হয় ট্রাইব্যুনালে। সরকার পক্ষের আপত্তির কারণে গত বুধবার মাওলানা সাঈদীর দুইজন নিকটাত্মীয়কে আদালত কক্ষ থেকে বের করে দেয়ার পর গতকাল পাস ইস্যুতে বেশ কড়াকড়ি আরোপ করা হয়। মাওলানা সাঈদীর ৩ ছেলে ছাড়া অন্যান্য আত্মীয়কে গতকাল পাসই দেয়া হয়নি।

গতকাল বিচারকের সমন্বয়ে গঠিত ট্রাইব্যুনাল আসন গ্রহণ করার পরপরই মাওলানা সাঈদীর আইনজীবী ব্যারিস্টার তানভীর আল আমিন ট্রাইব্যুনালকে জানান, আমার মক্কেল ডায়বেটিস আক্রান্ত এবং বয়োবৃদ্ধ। আদালতর কাঠগড়ায় দীর্ঘক্ষণ থাকার কারণে তিনি কোন খাদ্য গ্রহণ না করায় শারীরিক সমস্যা সৃষ্টি হচ্ছে। এ ব্যাপারে তিনি কাঠগড়ায় মাওলানা সাঈদীর হালকা খাওয়ানোর অনুমতি প্রার্থনা করেন। ট্রাইব্যুনালের চেয়ারম্যান বলেন, এতে কোন অসুবিধা নেই। আপনাদের ব্যবস্থাপনায় খাওয়াবেন। এরপরই ‘যাহা বলিব সত্য বলিব, মিথ্যা বলিব না, সত্য গোপন করিব না' বলে শপথ নিয়ে ২ নম্বর সাক্ষী রুহুল আমিন নবীন তার বক্তব্য শুরু করেন। প্রসিকিউটর সাইদুর রহমান তার সাক্ষ্য লিপিবদ্ধ করেন।

সাক্ষীকে ধীরে ধীরে বক্তব্য রাখতে বলা হয় এবং তা কম্পিউটারে লিপিবদ্ধ করা হয় যা সরাসরি অভিযুক্ত ব্যক্তি, প্রসিকিউশন, ডিফেন্স এবং ৩ বিচারক স্ক্রিনে দেখতে পান।

২ নম্বর সাক্ষী রুহুল আমিন নবীন তার অসমাপ্ত বক্তব্য সমাপ্ত করেন গতকাল সোয়া ১ ঘণ্টায়। এ সময় তিনি বলেন, ১৯৭১ সালের ৩ মে বর্বর পাকিস্তানীবাহিনী পিরোজপুর আগমন করে শান্তি কমিটির সাথে মিটিং করে। তারা পাকবাহিনীর কাছে আওয়ামী লীগের নেতাকর্মী ও মুক্তিযোদ্ধাদের বাড়ি-ঘর সম্পর্কে তথ্য দেয়। ৭ মে ২৬টি রিক্সাযোগে প্রায় ৫২ জন পাকসেনা আসে পাড়েরহাট। পাড়েরহাট রিক্সা স্ট্যান্ডে তাদেরকে অভ্যর্থনা জানায় শান্তি কমিটির নেতা সেকান্দার আলী সিকদার, দানেশ আলী মোল্লা, মাওলানা মোসলেহ উদ্দিন ও দেলাওয়ার হোসাইন সাঈদীসহ অনেকেই। এই বাহিনীর নেতৃতে ছিলেন ক্যাপ্টেন এজাজ। শান্তি কমিটির লোকেরা পাড়েরহাট বাজারে পাক সেনাদের নিয়ে প্রবেশ করে আওয়ামী লীগ ও হিন্দুদের বাড়ি-ঘর দোকানপাট ভেঙ্গে দেয়। ক্যাপ্টেন এজাজের সাথে সাঈদী সাহেব পরামর্শ করার পর বলা হয়, লে লো অর্থাৎ এগিয়ে লও। তখনই শান্তি কমিটির লোকজনও রাজাকারদের দেখিয়ে দেয়া দোকানপাট ও বাড়ি-ঘরে লুটপাট শুরু হয়। লুটের এক পর্যায়ে পাড়েরহাট বন্দরের ধনাঢ্য ব্যবসায়ী মাখন সাহার দোকানের মাটির নীচে লোহার সিন্দুক থেকে ২২ সের স্বর্ণ ও রূপা লুট করে। ঐসব স্বর্ণ ও রূপা পাক হানাদারবাহিনী নিয়ে যায়। একই দিন পাড়েরহাট বাজারের ৩০/৩৫টি দোকানের মেঝের মাটি খোঁড়া হয় আরো স্বর্ণ পাওয়ার আশায়। এই লুটের পর পাক হানাদারবাহিনী পাড়েরহাট রাজলক্ষ্মী উচ্চবিদ্যালয়ে ক্যাম্প স্থাপন করে। এর পূর্বেই ফকির দাসের দোকানে ২টি ক্যাম্প স্থাপন করে রাজাকাররা। পরের দিন ৮ মে পাড়েরহাট বন্দরের পূর্বপাড়ে পাদুয়া ও চিতলিয়া গ্রামে তৎকালীন ধনাঢ্য ব্যবসায়ী রইস উদ্দিন পসারী, হেলাল উদ্দিন পসারী ও মানিক পসারীর ঘরসহ ৭/৮টি ঘর লুটপাট করে। পরে তা জ্বালিয়ে ভস্ম করে দেয়া হয়।

১৯৭১ সালের জুন মাসের মাঝা-মাঝি সময়ে মুক্তিযোদ্ধাদের রসদ ক্রয়ের জন্য আমি পাড়েরহাট বাজারে আসি। মাসুম স্টোরের সামনে দাঁড়িয়ে থাকা অবস্থায় আমি দেখতে পাই পাঞ্জাবী ও মাল কোচা দিয়ে লুঙ্গি পরিহিত সাঈদী সাহেব। বোগলে একটি ঢেউটিন এবং কাসা পিতলের প্লেট গ্লাস, বাটি, জগ ভর্তি একটি ঝাকা মাথায় নিয়ে হেঁটে যাচ্ছে তৎকালীন দেলোয়ার হোসেন সিকদার। এসব লুটের মাল দেখে আমি উত্তেজিত হয়ে পড়ি। আমার কাছে থাকা রিভলভার দিয়ে শুট করব বলে মৌলবী নুরুল হককে বলি। তিনি আমাকে বাধা দিয়ে বললেন, এই মুহূর্তে ঝামেলা বাড়বে। যেসব ঘর-বাড়ি ও দোকানপাট পাড়েরহাটে অবশিষ্ট আছে তাও পাক বাহিনী জ্বালিয়ে দেবে এবং নির্বিচারে গণহত্যা চালাবে। পরে মফিজ উদ্দিন মৌলবীর দোকানের সামনে গিয়ে জানতে পারি মদন সাহার দোকান লুট হয়েছে। কিছুক্ষণ পর দেলোয়ার সাহেব কাঠ মিস্ত্রি তৈয়ব আলীসহ আরো ৪-৫ জন লোক নিয়ে মদন সাহার দোকানঘর ভাঙ্গা শুরু করে। ভাঙ্গার পর মালামাল নৌকাযোগে তার শ্বশুরবাড়ি ইউনুস মুন্সীর বাড়িতে নিয়ে যায়।

সাক্ষী রুহুল আমিন আরো বলেন, পাড়েরহাট বাজারের পুরাতন ঘর নগরবাসী সাহার দোকান ঘর জোর করে দখল করে পাঁচতহবিলের অফিস বানানো হয়। সাঈদীসহ আরো ৪/৫ জন এটা পরিচালনা করতো। আর সার্বিক দায়িত্বে ছিলেন দেলোয়ার হোসেন সিকদার। লুটপাটের সব মালামাল ঐ দোকানে এনে পাঁচতহবিলে ভাগ করা হতো। স্থান সংকুলান না হওয়ায় মাওলানা নাসিমের ঘরও গোডাউন হিসেবে ব্যবহার করা হয়। বিজন সাহার মেয়ে ভানু সাহাকে পাকিস্তানী বাহিনী ধর্ষণ করে। সাক্ষ্য-প্রদানের শেষে এই জায়গায় তিনি অতিরিক্ত যোগ করেন যে, ভানু সাহাকে কয়েক মাস আটকে রেখে পাক হানাদার বাহিনী ধর্ষণ করে।

রুহুল আমিন নবীন আরো অভিযোগ করেন যে ৫০/৬০ জন হিন্দুকে শান্তি কমিটির লোকেরা জোরপূর্বক হিন্দু থেকে মুসলমান ধর্ম গ্রহণ করায় এবং ৫ ওয়াক্ত নামায পড়তে বাধ্য করে মসজিদে গিয়ে। ২/৪টি আরবী সূরাও শেখানো হয়। স্বাধীনতার পর তারা আবার স্বধর্মে ফিরে আসে। পাকিস্তানী হানাদার বাহিনী কর্তৃক ধর্ষিতা ছবি রায় ও ভানুসাহা পরে ভারতে পালিয়ে যায়। আমি ভারতে ট্রেনিং শেষে দেশে এসে বিভিন্ন স্থানে পাক বাহিনীর সাথে যুদ্ধ করি। স্বাধীনতার পর অনেক স্থানে অনুসন্ধান চালিয়ে হত্যা, লুণ্ঠন, নারী ধর্ষণকারী রাজাকারদের অনেককে আটক করতে পারলেও দেলোয়ার সিকদারকে গ্রেফতার করতে পারি নাই। শুনতে পাই তিনি পালিয়ে গেছেন, আমরা মুক্তিযোদ্ধারা তল্লাশি চালিয়ে লুট হওয়া মালামাল উদ্ধার করে তাদেরকে ফেরত দিই, মদন সাহার যে ঘরটি লুট করে নেয়া হয়, সাঈদী সাহেবের শ্বশুরবাড়ী থেকে ঐ ঘরটি উদ্ধার করে এনে মদন সাহাকে ফেরত দিই। সাক্ষী নবীন আরো জানান, ১৯৮৬ সালে পারেরহাট উচ্চ বিদ্যালয় মাঠে সাঈদী সাহেব একটি মাহফিল করেন তার দলীয় জামায়াতে ইসলামীর সহায়তায়। আমি বাধা দিতে পারি মনে করে মোকাররম হোসেন কবিসহ ৩ জন জামায়াত কর্মী আমার বাড়িতে আসে। আমি তাদেরকে বলি রাজনৈতিক বক্তব্য দিলে মাহফিল করতে দেয়া হবে না। তিনি হত্যা, ধর্ষণ, লুটপাট, অগ্নিসংযোগের সাথে জড়িত সকল রাজাকার, শান্তি কমিটির সদস্যদের উপযুক্ত বিচার প্রার্থণা করেন।

সাক্ষী নবীনের সাক্ষ্য প্রদান শেষে মাওলানা সাঈদীর আইনজীবী এডভোকেট মিজানুল ইসলাম তার কাছে জানতে চান যে এ এলাকার মুক্তিযোদ্ধা কমান্ডার ও সাব কমান্ডার কারা ছিলেন? ব্যারিস্টার শাজাহান ওমর কি দায়িত্বে ছিলেন তাও জানতে চান। জবাবে নবীন জানান, শাজাহান ওমর ঝালকাঠি জেলার রাজাপুর থানার কমান্ডার ছিলেন। মেজর জিয়াউদ্দিন ছিলেন সাব সেক্টর কমান্ডার, সেকেন্ড ইন কমান্ড ছিলেন শামসুল হক যাকে আমি এডভোকেট বলে জানি। তবে তার সনদ ছিলো কি না জানি না। আমার ভাই জামাল উদ্দিন কোনো দায়িত্বে ছিলো না। আমার অধীনেই ছিলো।

সাংবাদিকদের ব্রিফিংকালে এডভোকেট মিজানুল ইসলাম (রাজশাহী বার থেকে আগত) বলেন, মাত্র ২ জন সাক্ষীর সাক্ষ্য প্রদান শেষ হয়েছে। তাদের জেরা করা হবে আগামী রোববার। এই পর্যায়ে এই মামলার মেরিট সম্পর্কে কিছু বলা যাবে না।

অভিযুক্ত পক্ষে গতকাল ট্রাইব্যুনালে ছিলেন ব্যারিস্টার আব্দুর রাজ্জাক, রাজশাহী বার থেকে আসা এডভোকেট মিজানুল ইসলাম, চট্টগ্রাম বার থেকে আসা এডভোকেট মনজুর আহমেদ আনসারী ও কফিল উদ্দিন চৌধুরী, হাইকোর্টের আইনজীবী ব্যারিস্টার তানভীর আল আমিন, ব্যারিস্টার অনুশী আহসান কবির, এডভোকেট ফরিদ উদ্দিন খান, শাজাহান কবির প্রমুখ। সরকার পক্ষে ছিলেন চিফ প্রসিকিউটর গোলাম আরিফ টিপু, প্রসিকিউটর এস হায়দার আলী, সৈয়দ রেজাউর রহমান, জিয়াদ আল মালুম প্রমুখ।

সেক্টর কমান্ডার, বীর উত্তম, বীর বিক্রম, বীর প্রতীক কেউ বাদ নেই----রাজনৈতিক বিরোধিতার কারণে আওয়ামী লীগের প্রতিহিংসার শিকার মুক্তিযুদ্ধের শ্রেষ্ঠ সন্তানরাও

সরদার আবদুর রহমান : আওয়ামী লীগের বিরোধিতা মানেই স্বাধীনতার বিরোধিতা-এই দৃষ্টিভঙ্গি থেকে এক চরম প্রতিহিংসামূলক আচরণ করে চলেছে ক্ষমতাসীন দলটি। এই প্রতিহিংসার শিকার হয়েছেন এবং হচ্ছেন মুক্তিযুদ্ধের শ্রেষ্ঠ সন্তানরাও। তাতে তিনি বীর বিক্রমই হোন আর বীর প্রতীকই হন। এমনকি সেক্টর কমান্ডার হলেও তার রেহাই নেই।

এভাবে একের পর এক আওয়ামী বিদ্বেষের কবলে নিপতিত হয়েছেন মুক্তিযুদ্ধের সেক্টর কমান্ডার জিয়াউর রহমান বীর উত্তম, সেক্টর কমান্ডার মেজর এমএ জলিল, মেজর জয়নুল আবেদীন ও উইং কমান্ডার হামিদুল্লাহ খান বীর প্রতীক, মুক্তিযুদ্ধের বিখ্যাত কাদেরিয়া বাহিনীর প্রধান কাদের সিদ্দিকী বীর উত্তম, কর্নেল অলি আহমদ বীর বিক্রম প্রমুখ।

আওয়ামী লীগ না করে বাংলাদেশ জাতীয়তাবাদী দল-বিএনপি নামে পৃথক রাজনৈতিক দল গঠন এবং বাকশাল নামক একদলীয় শাসন ব্যবস্থার অবসান ঘটিয়েছিলেন মুক্তিযুদ্ধের অন্যতম সেক্টর কমান্ডার জিয়াউর রহমান। এই ‘অপরাধে' তাঁর ‘স্বাধীনতার ঘোষক' হিসেবে স্বীকৃতির দাবিটি উচ্চ আদালতে পর্যন্ত নিয়ে যাওয়া হয়েছে। আর তিনি আদৌ সেক্টর কমান্ডার ছিলেন না বলেও এখন দাবি তোলা শুরু হয়েছে। ‘জেড ফোর্স'-এর জিয়াউর রহমানকে কোন কোন আওয়ামী লীগ নেতা মুক্তিযুদ্ধকালে পাকিস্তানের চর বলতেও ছাড়েননি।

সেক্টর কমান্ডার্স ফোরামের ওয়েব সাইট থেকেই জানা যায়, তৎকালীন মেজর জিয়াউর রহমান ১৯৭১ সালের ১০ এপ্রিল থেকে ২৫ জুন পর্যন্ত চট্টগ্রাম জেলা ও পার্বত্য অঞ্চল এবং নোয়াখালি জেলার সমগ্র পূর্বাঞ্চল মিলে গঠিত ১নং সেক্টরের কমান্ডার ছিলেন। এই সেক্টরের হেড কোয়ার্টার ছিল হরিণা। এখান থেকে জিয়াউর রহমানকে ১১ নং সেক্টরে বদলি করা হয়। এখানে তিনি ২৭ জুন থেকে ১০ অক্টোবর পর্যন্ত দায়িত্ব পালন করেন। এই সেক্টরের অধীনে ছিল ময়মনসিং ও টাঙ্গাইল এবং রংপুর, গাইবান্ধা, উলিপুর, কামালপুর ও চিলমারী এলাকা। এর হেড কোয়ার্টার প্রথমে ছিল তেলঢালা, পরে তা মাহেন্দ্রগঞ্জে স্থানান্তর করা হয়। একই সেক্টরে ২ নবেম্বর থেকে ১৪ ফেব্রুয়ারি পর্যন্ত সেক্টর কমান্ডারের দায়িত্ব পালন করেন তৎকালীন স্কোয়াড্রন লীডার এম হামিদুল্লাহ খান। এর আগে তিনি জিয়ার অধীনে এই সেক্টরের সাব সেক্টর কমান্ডারের দায়িত্ব পালন করেন। কিন্তু নিজেদের ওয়েব সাইটের তথ্য অস্বীকারের চেষ্টা করছে কথিত সেক্টর কমান্ডার্স ফোরাম। হামিদুল্লাহ খান আওয়ামী লীগের রাজনীতির বিরোধিতা করেন বলে তাকেও অস্বীকারের নীতি গ্রহণ করেছে আওয়ামী লীগের এই অঙ্গ সংগঠনটি। উল্লেখ্য, মুক্তিযুদ্ধে সেক্টরভিত্তিক দায়িত্ব পালনকারী ব্যক্তিদের ২২ জনের মধ্যে মাত্র ৪ জনকে নিয়ে চালানো হচ্ছে সেক্টর কমান্ডার্স ফোরাম। মেজর জিয়া ‘জেড ফোর্স'-এর অধীন গেরিলা বাহিনীরও নেতৃত্ব দেন। তাঁর অধীনে ছিল ১, ৩ ও ৮ নং ইস্টবেঙ্গল রেজিমেন্ট। তাঁর অধীনে অন্য কমান্ডাররা ছিলেন, মেজর জিয়াউদ্দীন, মেজর সাফায়াত জামিল ও মেজর আমিনুল হক।

মুক্তিযুদ্ধের আরেক সেনানী মেজর এমএ জলিল ভারতীয় আধিপত্যবাদী নীতি এবং মুক্তিযুদ্ধ শেষে ভারতের লুণ্ঠনের প্রতিবাদ করায় বিরাগভাজন হন। তাঁকে মুক্তিযুদ্ধের ইতিহাস থেকে নির্বাসিত করা হয়। এমনকি মহাজোটের শরীক দল জাসদ তাদের অন্যতম প্রতিষ্ঠাতাকেও মুছে ফেলার চেষ্টায় আছে। উল্লেখ্য, মেজর জলিল মুক্তিযুদ্ধের ৯ নং সেক্টরের কমান্ডার ছিলেন ১৭ জুলাই থেকে ২৪ ডিসেম্বর পর্যন্ত। তাঁর এলাকা ছিল বরিশাল, পটুয়াখালি, ফরিদপুর এবং খুলনার অংশবিশেষ। একই সেক্টরে কমান্ডারের দায়িত্ব পালন করেছেন মেজর জয়নুল আবেদীন। তিনি আওয়ামী লীগের রাজনীতির বিরোধী বলে তাকে কারান্তরালে ধুঁকে ধঁকে জীবনপাত করতে হয়। সেক্টর কমান্ডার মেজর জলিল এবং মেজর জয়নুল আবেদিন স্বাধীনতার পর পর বাংলাদেশে ভারতের লুণ্ঠনকর্মে বাধ সাধলে তদানীন্তন সরকার ভারতের চাপে তাদের গ্রেফতার করেছিল। মেজর (অব.) জলিল মারা গেছেন আর মেজর (অব.) জয়নুল আবেদিন এখনও ঢাকা জেলের সাত নম্বর সেলে সাধারণ বন্দির জীবনযাপন করে চলেছেন বলে জানা যায়।

মেজর এমএ জলিলের নিজ লেখনী থেকেই তাঁর ভারতবিরোধিতার কারণ জানা যায়। তিনি ‘অরক্ষিত স্বাধীনতাই পরাধীনতা' নামক গ্রন্থে উল্লেখ করেন, ‘‘... এখানে একটা বিষয় সকলেরই পরিষ্কার হওয়া প্রয়োজন এবং তা হচ্ছে স্বাধীনতার সেই উষালগ্নে বিধ্বস্ত বাংলাদেশের সম্পদ রক্ষা করার যে আগ্রহ এবং বাসনা আমরা প্রদর্শন করেছি তা ছিল আমাদের জাতীয় সম্পদ রক্ষা করারই স্বার্থে কেবল, ভারত বিরোধী হয়ে উঠার জন্য নয়। জাতীয় সম্পদ রক্ষার চেষ্টা কেবল নিঃস্বার্থ দেশপ্রেমেরই লক্ষ্য, কারো বিরুদ্ধে শত্রুতা সৃষ্টি করার ষড়যন্ত্র মোটেও নয়। বন্ধু ভারত এখানে হিসেবে ভুল করেছে আর তাই দেশপ্রেমের পুরস্কার হিসেবে আমাকে যশোর থেকে ‘এমবুশ' করে অর্থাৎ গোপনে ওঁৎ পেতে থেকে ভারত-বাংলাদেশ যৌথ বাহিনী সশস্ত্র উদ্যোগে গ্রেফতার করে। আমারই সাধের স্বাধীন বাংলায় আমিই হলাম প্রথম রাজবন্দী। ২১শে ডিসেম্বর বেলা ১০টা সাড়ে দশটায় আক্রমণকারী বাহিনীর হাতে বন্দী হয়ে বাংলাদেশের স্বাধীনতার আসল রূপের প্রথম দৃশ্য দেখলাম আমি। ভারতীয় সৈন্যবাহিনীর মদদে বাংলাদেশ স্বাধীন করার অর্থ এবং তাৎপর্য বুঝে উঠতে আমার তখন আর এক মিনিটও বিলম্ব হয়নি।’’

মুক্তিযুদ্ধের বিখ্যাত কাদেরিয়া বাহিনীর প্রধান কাদের সিদ্দিকী বীর উত্তমকেও ছেড়ে দেয়নি আওয়ামী লীগ। তিনি আওয়ামী লীগ করেননি, বরং তাদের নানাবিধ গণবিরোধী কাজের প্রতিবাদ করেছেন বলে তিনি তাদের রোষানলে পতিত হয়েছেন। ক্ষমতাসীন আওয়ামী লীগের অন্যতম নেতা কৃষি মন্ত্রণালয়-সম্পর্কিত সংসদীয় স্থায়ী কমিটির সভাপতি শওকত মোমেন শাহজাহান তীব্র কণ্ঠে দাবি করেন, ‘কাদের সিদ্দিকী একজন যুদ্ধাপরাধী। তাই তাঁর বিচার হওয়া উচিত।' সম্প্রতি টাঙ্গাইলের সখীপুর উপজেলার নলুয়া এয়ারফোর্স বাজারে যুদ্ধাপরাধীদের বিচার ও ফাঁসির দাবিতে আয়োজিত এক জনসভায় শওকত মোমেন এ দাবি করেন। যুদ্ধাপরাধীর সংজ্ঞা দিতে গিয়ে টাঙ্গাইল-৮ (বাসাইল-সখীপুর) আসনের এমপি শওকত মোমেন বলেন, ‘যারা মুক্তিযুদ্ধের সময় লুণ্ঠন, ডাকাতি, ধর্ষণ ও মানুষ খুন করেছে তারাই যুদ্ধাপরাধী। যেহেতু কাদের সিদ্দিকী মুক্তিযুদ্ধের সময় টাঙ্গাইল সোনালী ব্যাংক থেকে ১৯ লাখ টাকা লুট করেছেন, ব্যাংকে রাখা ২০ কেজি স্বর্ণ ডাকাতি করেছেন, করটিয়া ও দেলদুয়ার জমিদার বাড়ি লুট করেছেন এবং যুদ্ধের সময় নিরপরাধ লোকজনকে হত্যা করেছেন, এ জন্য তিনিও একজন যুদ্ধাপরাধী। তাই তাঁর বিচার হওয়া উচিত।' যাদবপুর ইউনিয়ন আওয়ামী লীগের সভাপতি আমজাদ হোসেনের সভাপতিত্বে আয়োজিত ওই জনসভায় প্রধান অতিথি ছিলেন সাবেক স্বরাষ্ট্রমন্ত্রী মোহাম্মদ নাসিম। মুক্তিযুদ্ধে বীর উত্তম খেতাব পাওয়া কাদের সিদ্দিকীকে ‘যুদ্ধাপরাধী' উল্লেখ করে বক্তব্য দেয়ায় বিভিন্ন মহলে তীব্র প্রতিক্রিয়া দেখা গেছে।

এর আগে কৃষক শ্রমিক জনতা লীগ চেয়ারম্যান বঙ্গবীর কাদের সিদ্দিকী বলেছিলেন, ‘আজ অনেকেই বড় বড় কথা বলছেন এবং মুক্তিযোদ্ধা হয়েছেন। কিন্তু পাকিস্তানের সঙ্গে যুদ্ধ করার সময় তাদের পাওয়া যায়নি। সরকার একজনকে আইনের হাফ মন্ত্রী বানিয়ে রেখেছে। এই আইন প্রতিমন্ত্রী আইনের ‘অ' জানেন কিনা সন্দেহ। তার আত্মীয়স্বজন সবাই রাজাকার ছিল। এখন তিনি আওয়ামী লীগ সরকারের একজন মন্ত্রী। দলে থাকলে মুক্তিযোদ্ধা না থাকলে রাজাকার।'

আরেক বিশিষ্ট মুক্তিযোদ্ধা এলডিপির সভাপতি কর্নেল (অব.) অলি আহমদ বীর বিক্রম আওয়ামী লীগের আক্রমণের কবলে পতিত হন সম্প্রতি। কারণ তিনি আওয়ামী লীগের সমালোচনা করেছিলেন। গত ২৪ নবেম্বর চট্টগ্রাম আওয়ামী লীগের এক নেতার দায়ের করা একটি মানহানির মামলায় চট্টগ্রামের আদালতে হাজিরা দিতে গেলে কর্ণেল অলি আহমদের ওপর হামলা করে আওয়ামী লীগের নেতা-কর্মীরা। তিনি আদালত চত্বরে গেলে এ ঘটনা ঘটে। এ সময় আদালত চত্বরে আওয়ামী লীগ-যুবলীগ ও এলডিপি কর্মীদের মধ্যে কয়েক দফা সংঘর্ষ, ভাংচুর এবং ধাওয়া-পাল্টা ধাওয়ার ঘটনা ঘটে। এতে উভয়পক্ষের কর্মী ও সাংবাদিকসহ কমপক্ষে ১০ জন আহত হয়। উত্তপ্ত পরিস্থিতিতে অলি আহমদ জেলা আইনজীবী সমিতির অফিসে আশ্রয় নেন। এখানেই শেষ নয়, পরিকল্পনা মন্ত্রণালয় সম্পর্কিত সংসদীয় স্থায়ী কমিটি থেকে এলডিপি সভাপতি অলি আহমদের অপসারণ দাবি করে স্বেচ্ছাসেবক লীগ। কর্নেল অলি আওয়ামী লীগের সমালোচনা করে বলেছিলেন, ‘আওয়ামী লীগ মানেই বেঈমান। তারা কথা দিয়ে কথা রাখে না। আগামী নির্বাচনে জনগণ এর জবাব দেবে।' সাতকানিয়া উপজেলার কেউচিয়া ইউনিয়ন এলডিপির এক জনসভায় তিনি এসব কথা বলেন। কর্নেল অলি বলেন, ‘আওয়ামী লীগ ১০ টাকা কেজিতে চাল খাওয়ানোর কথা বলে জনগণের ভোট নিয়ে প্রতারণা করেছে। এখন দেশের মানুষকে উপোস রেখে আওয়ামী লীগের মন্ত্রীরা সম্পদের পাহাড় গড়েছে। আগামী নির্বাচনে জনগণ এর জবাব দেবে। জীবনে আর কখনও আওয়ামী লীগ ক্ষমতায় আসতে পারবে না।' তিনি আরও বলেন, ‘এই সরকারের মন্ত্রীরা পান-সুপারি চোরদের মতো হয়ে গেছে। যেখানে পারছে লুটপাটে মেতে উঠেছে।' এ সময় তিনি নরসিংদীর পৌর মেয়র হত্যার ঘটনা প্রসঙ্গে বলেন, ‘আওয়ামী লীগের সন্ত্রাসীরা এতো বেপরোয়া হয়ে উঠেছে যে তাদের দলীয় লোকও রেহাই পাচ্ছে না। তারা নিজ দলের পৌর মেয়রকে হত্যা করেছে। তিনি বলেন, দেশের মানুষকে অশান্তিতে রেখে তারাও শান্তিতে থাকতে পারবে না। অচিরেই এই সরকারের বিদায় ঘণ্টা বেজে উঠবে।